গত ২৫ শে শ্রাবণ, ১৪২৪ বাং (১১ই আগস্ট, ২০১৭ ইং) তারিখে আমাদের পরম পূজনীয় শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রমোহন নাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ৷ তাঁর জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ব-বঙ্গের সিলেট জিলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম হোঁরগাঁওতে ৷ ২৬ শে চৈত্র, ১৪২৪ বাং (৯ই আগস্ট, ১৯২৭ ইং) তারিখে ৷ একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে ৷ পিতা হরিমোহন নাথ ৷ মাতা শান্তিময়ী নাথ৷ পরিবারের জ্যেষ্ঠ ছেলে দেবেন্দ্রমোহন নাথ, ওরফে দেবু ৷ এরপর তিন বোন ৷ জন্মদিনটি ছিল খুবই স্মরণীয় ৷ কারণ, সেদিন ভূমিকম্পে মেদিনী কেঁপে উঠেছিল ৷ অমারাত্রির শেষে সূর্য ওঠে ৷ ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় দেবু ভীষণ তুখোড় ৷ প্রতি-বছর জলপানি বা বৃত্তি পেতেন ৷ হোঁরগাঁওতে প্রাথমিক শিক্ষা ৷ এরপর ভর্তি হন হবিগঞ্জ হাই স্কুলে৷ থাকতেন স্কুলের বোর্ডিং-এ ৷ মেট্রিক পরীক্ষা দেন হবিগঞ্জের প্রখ্যাত উকিল হরমোহন নাথের বাড়িতে থেকে ৷ স্কুলের শিক্ষকদের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রটি অংক এবং সংস্কৃতে লেটারসহ, স্টার মার্কস নিয়ে মেট্রিক পাশ করেন ৷
এরপর পাড়ি জমান কলকাতায় ৷ প্রথমে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে ৷ কলা বিভাগে ৷ বিজ্ঞান পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সী কলেজে ছেড়ে দেন ৷ এবার ভর্তি হন বিদ্যাসাগর কলেজে৷ বন্ধু-প্রীতির জন্য এক বছর পরীক্ষায় ড্রপ দেন ৷ সেখান থেকেই বিজ্ঞানে স্নাতক ৷ হবিগঞ্জ হাই স্কুলের সাথেই ছিল প্রখ্যাত গণ-সংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাড়ি ৷ জমিদার বাড়ির ছেলে ৷ বয়সে দেবুর চেয়ে বড় ৷ ছোটভাই, স্কুলে দেবুর সহপাঠী৷ হেমাঙ্গ বিশ্বাস তখনই সাথীদের নিয়ে স্বদেশী আন্দোলন যুক্ত হয়েছিলেন ৷ গান বাঁধতেন৷ এর রেশ দেবুর পরবর্তী জীবনেও রয়ে যায় ৷ কলকাতায় এসে আই পি টি এ-র প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন ৷ একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন৷ সাথে ছিলেন ছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থক ৷
প্রথম চাকুরী পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে কলকাতায় সরকারী পরিসংখ্যান দপ্তরে ৷ তারপর কলকাতার টি-বোর্ডে উচ্চপদে চাকুরীতে যোগ দেন ৷ সেখানে তাঁর সহকর্মী ছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী প্রসাদ সেন ৷ বিয়ে করেন ১৯৫৮ সালের ৮ই মার্চ ৷ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ৷ স্ত্রী শ্রীমতী নীলিমা নাথ ওরফে টুকু ৷ শিলচরের প্রখ্যাত সমাজ-সংস্কারক সোমনাথ পণ্ডিতের নাতনি এবং প্রধান-শিক্ষক পাণ্ডবচন্দ্র নাথের কন্যা ৷ বয়সে তাঁর চেয়ে বার-তেরো বছরের ছোট ৷ অত্যন্ত সুন্দরী এবং মৃদুভাষী টুকু, হয়ে উঠেছিলেন তাঁর যোগ্য সহধর্মিণী ৷ সুখ-দুঃখের সাথী ৷
বিয়ের পর ভাড়া থাকতেন প্রখ্যাত উকিল আদিনাথ গাঙ্গুলিদের বাড়িতে ৷ সেখানেই ১৯৫৯-এর জুনে তাঁর বড় ছেলের জন্ম ৷ ততদিনে দেশ-বিভাগ হয়েছে ৷ স্বাধীনতার আগেই তাঁর বাবা-কাকারা জমি হস্তান্তর করে চলে এসেছিলেন ত্রিপুরার ধর্মনগরে ৷ কিন্তু জীবন-সংগ্রামে বার বার পিছিয়ে পড়ছিলেন৷ ষাটের দশকের প্রথম দিকে টি-বোর্ডের ভালো চাকুরী ছেড়ে তিনিও চলে আসেন ত্রিপুরায় পরিবারের হাল ধরতে ৷ ১৯৬০ সালের শেষ দিকে শিক্ষকতার চাকুরী নিয়ে যোগ দেন ধর্মনগর বালিকা বিদ্যালয়ে ৷ দীর্ঘদিন সেই স্কুলে চাকুরী করেন ৷ তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্রীদের কাছে তিনি দেবেন স্যার হিসাবে আজীবন পরিচিত ছিলেন ৷ অবসরের আগে, শেষের তিন-চার বছর পদোন্নতি নিয়ে সহকারী প্রধান-শিক্ষক হিসাবে চাকুরী করেন ধর্মনগরের গঙ্গানগর এবং পদ্মপুর উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলে৷
ধুতি-পাঞ্জাবী, চটি এবং ছাতি এই ছিল তাঁর পোশাক ৷ ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে,ওই যে তিনি, ও ই যে বাহির পথে’, গানটি কবিগুরু যেন তাঁকে দেখেই রচনা করেছিলেন ৷ মাছ-ভাত খেতে ভালোবাসতেন ৷ একসময় পান খেতেন ৷ ফ্যারেনজাইটিসে ভুগে ছেড়ে দেন ৷ প্রতিদিন সকালে যোগ-ব্যায়াম ও প্রাতঃভ্রমণ করতেন ৷ বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যের উপর তাঁর ছিল অগাধ দখল ৷ রবীন্দ্র সংগীত শুনতে ভালোবাসতেন ৷ জর্জ বিশ্বাস ছিলেন তাঁর প্রিয় শিল্পী৷ বিশেষত:, শিল্পীর কণ্ঠে ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’, গানটি ছিল তাঁর খুবই প্রিয় ৷
তাঁর অনুকরণীয় জীবন-শৈলী আত্মীয়-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব এবং ছাত্র-ছাত্রী সবার মনেই প্রভাব ফেলত ৷ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষে তাদেরকে সৎ-নাগরিক হয়ে ওঠার পথে প্রেরণা যুগিয়েছে ৷ সফল শিক্ষকের পাশাপাশি, শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রমোহন নাথ একজন সফল পিতাও বটে ৷ তাঁর নীতি আদর্শ এবং সংস্কৃতি-মনা মনের পরশ ছেলে-মেয়ে এবং নাতি-নাতনিদের মধ্যে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছেন ৷ তিন ছেলে এবং তিন মেয়ের সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ৷ প্রত্যেকেই আজ নিজ-নিজ পরিচিতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ৷
যৌবনে আই পি টি এ-র পরশ, তাঁকে কর্মজীবনে কর্মচারী আন্দোলনে এক অগ্রণী ভূমিকা নিতে প্রেরণা যুগিয়েছে ৷ চাকুরী থেকে অবসরের পর তিনি দশ-বারো বছর বাম-পন্থী আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রেখেছিলেন ৷ সফল সংঘটক হিসাবে অবিভক্ত উত্তর জেলায় দেবেন্দ্রমোহন নাথ এখনও একটি পরিচিত নাম ৷ গত ষোল-সতের বছর যাবত তিনি নিজেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে মুক্ত রেখেছিলেন ৷
গত ১৬ই এপ্রিল, ২০১৫ ইং তিনি বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পান ৷ কলকাতার DESUN
হাসপাতালে গত ২৫শে এপ্রিল, ২০১৫ ইং তাঁর অপারেশন হয় ৷ করেন ডাঃ রুদ্রজিত কাঞ্জিলাল ৷ কাকতালীয় ভাবে তাঁকে যখন অপারেশন টেবিলে তোলা হয়, সেই মুহূর্তে মেদিনী আবার কেঁপে ওঠে ৷ সেটা ছিল নেপালে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের প্রথম দিন৷ ৬ই মে, ২০১৫ ইং তারিখে তাঁকে আগরতলার আই জি এম হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় ৷ তাঁর বড়ছেলে ডাঃ দেবাশিস নাথের চিকিৎসায় তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন ৷ তবে মাঝে-মধ্যেই আই সি ইউ-তে ভর্তি হতেন ৷ এবারে, আই জি এমের আই সি ইউ-তে ভর্তি হন ১৩ই জুলাই, ২০১৭ ইং তারিখে ৷ অত্যন্ত প্রচার-বিমুখ, রবীন্দ্রানুরাগী এই শিক্ষাবিদের মৃত্যু হয় ১১ই আগস্ট, ২০১৭ ইং তারিখে ৷ তিনি ছিলেন নিজের সময়ের চেয়ে এগিয়ে ৷ তাই তিনি মরণোত্তর দেহ দান করে গিয়েছেন ৷ তাঁর ইচ্ছানুযায়ী, ১২ই আগস্ট, ২০১৭ ইং তারিখে তাঁর দেহ, এ জি এম সি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৷
তাঁর জীবনের শেষ দিনটিও প্রকৃতি প্রথম দিনের মত স্মরণীয় করে রেখেছে ৷ কাকতালীয় ভাবে, সেদিন আগরতলায় অকল্পনীয় বৃষ্টি ও বন্যা পরিলক্ষিত হয় ৷ এই অতল জলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি চলে গেলেন ৷ কাউকে সুযোগই দিলেন না তাঁর জন্য উতলা হতে ৷ তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে তাঁর ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, ছাত্র-ছাত্রী এবং অসংখ্য শুভানুধ্যায়ীরা, তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করে ৷ ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর ৷৷’