Sunday, 19 February 2017
Saturday, 11 February 2017
Friday, 10 February 2017
Wednesday, 8 February 2017
Monday, 6 February 2017
পুস্তক পর্যালোচনা 'নাম রেখেছি বনলতা' (২০১৭)- অরিন্দম নাথ
'নাম রেখেছি বনলতা' (২০১৭)- অরিন্দম নাথ
প্রকাশক- শ্রীমতী অঞ্জনা দাম, বুক ওয়ার্ল্ড, আগরতলা
প্রচ্ছদ- শ্রী অপরেশ পাল
বিনিময়- ২৫০ টাকা
ত্রিপুরা রাজ্যের আরক্ষা দপ্তরের স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ সুপার অরিন্দম নাথ । সাহিত্যের ভুবনেও তাঁর অবাধ বিচরণ । তাই তাঁকে সব্যসাচী বলেও আখ্যা দেওয়া যায় । ২০১৬ পর্যন্ত তাঁর ৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রতিটি গ্রন্থই প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে । বর্তমান বর্ষে (২০১৭) প্রকাশিত 'নাম রেখেছি বনলতা' তাঁর ৭ম গ্রন্থ । সত্যিই, এটি এক অভিনব গ্রন্থ । ১৮৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে 'অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে', 'মুড়ির টিনের স্মৃতি', ‘মহুরি নদীর উৎস স্রোতে', 'চক্ষে আমার তৃষ্ণা', 'গান্ধারীর ঐশ্বর্য', এধরনের মোট ৩৯ টি গল্প স্থান পেয়েছে । কিন্তু সাহিত্যের রূপ রীতি অনুসারে 'ছোট গল্প' (short story) বলতে যা বোঝায় এগুলিকে ঠিক তেমনি ছোটগল্প হয়তো বলা যাবে না । লেখকও লেখাগুলিকে কয়েকটি সফরের বর্ণনা বলে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু আমার মনে হয়, এগুলিকে একথায় রম্য কথা বলে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে । কারণ লেখাগুলো পড়তে পড়তে পাঠাকের মনে হয় যে, তাঁদের এক আপনজন যেন শীতের রাতে আগুন পোহাতে পোহাতে তাঁদের সাথে একের পর এক মনোমুগ্ধকর কথা বলে চলেছেন । কী নেই এসব কথায় ? সবই আছে । বাস্তব ঘটনা, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, ভূগোল, রূপকথা, উপকথা, পুরাকাহিনি (Myth), এডভেঞ্চার, গোয়েন্দা রহস্য, দুর্বৃত্ত ধরণ ও দমন ইত্যাদির সঙ্গে লেখকের কল্পনার রঙে সম্মিলনে এসব সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠেছে এক অভিনব সাহিত্য ।
লেখকের ছাব্বিশ বছরের চাকরির প্রথম দশ বছর কেটেছে সমগ্র ত্রিপুরার গ্রাম-গঞ্জে, পাহাড়-অরণ্যে উগ্রপন্থী দমনে । সেই বৈরী দমনে তাঁর ও তাঁর সহযোগীদের রোমাঞ্চকর, বিপদসংকুল অভিযানের সাফল্য ও ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বাস্তবের সঙ্গে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে এক অভিনব সাহিত্যের ঝুলি আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছেন । পড়তে পড়তে মনে হয়, ত্রিপুরাকে তাঁর মত এত গভীর ভাবে জানেন এমন লোক আর কেউ আছেন কিনা সন্দেহ । সমগ্র ত্রিপুরার রাজপথ থেকে গলি, সমতল থেকে পাহাড়, 'মাকড়সার জালের মত' বন্য পথ-ঘাট, সবই যেন তাঁর হাতের তালু । তাই এই গ্রন্থটি পর্যটকদের কাছেও একটি বিশ্বস্ত ভ্রমণ সঙ্গী বলে বিবেচিত হবে । ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানের নামকরণ সম্পর্কিত নানান অজানা কথাও লেখক আমাদের শুনিয়েছেন । তাঁর মতে, ককবরকে জলপ্রপাতকে বলা হয় 'দুঙ্গুর' । বাংলা ভাষীদের কল্যাণেই নাকি তা হয়ে গেছে 'ডুম্বুর'। তেমনি 'টাকার জলা' নামটিও নাকি এসেছে ককবরক শব্দ 'তখা জলাই' থেকে, বাঙ্গালিদের দ্বারা রূপান্তরিত হয়ে । এমনি ' বিশ্রামগঞ্জ', 'ফুলকুমারী', ছৈলেংটা', 'জামজুড়ি'র মত অসংখ্য স্থান নামের ব্যাখ্যাও করেছেন লেখক ।
চোর-ডাকাত, উগ্রপন্থীদের বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের বর্ণনা যেমনি দিয়েছেন, তেমনি তাঁদের পাকড়াও করার কাহিনিও লিপিবদ্ধ করেছেন । রয়েছে চাবি কিংবা মাধুরীর মত উপজাতি মেয়েদের সাহায্যে খুনী ও উগ্রপন্থীদের আটক করার কাহিনিও । চাবির সহায়তায় অরিন্দমবাবুরা যেমনি তারই এক আত্ম সমর্পণকারী বৈরী ও খুনী ভাইটিকে ধরতে পেরেছিলেন, তেমনি মাধুরীর সহায়তায় এক অভিযানে নেমে দুটি উগ্রপন্থীকে সেদিন ধরতে না পারলেও কিন্তু একটি এ.কে. ৪৭ কে উদ্ধার করতে পেরেছিলেন । সেদিন মাধুরী নাকি উগ্রপন্থী দুটিকে তার টংঘরে কথার জালে দীর্ঘসময় জড়িয়ে রেখেছিল পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে । এমনি নানান রুদ্ধশ্বাস ঘটনার একটি অপরূপ মালা যেন এ গ্রন্থ ।
চা পাতার আবিষ্কার কীভাবে হল, পাছড়ার রঙ ও নক্সা দেখে কীভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপজাতি রমণীদের চেনা যেতে পারে, জোঁকের কামড়ে রক্ত বন্ধে যে শিমূল তূলা অব্যর্থ, কিংবা মাকড়সারা কীভাবে জাল বোনে ইত্যাদি অজস্র তথ্যও পাঠক এ গ্রন্থ থেকে জানতে পারেন ।
অরিন্দমবাবুর সদা হাস্য মুখের মত তাঁর ভাষাও হাস্যোজ্জল । তাইতো তিনি কৌতুকের ভঙ্গিমায় বলতে পারেনঃ
(ক) ''উগ্রবাদীরা পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর কাছে ঈশ্বরের মতো । কারণ ঈশ্বর আমাদেরকে দেখতে পারেন। কিন্তু বিপরীতটা সব সময় সত্য নয় ৷”৷৷ (শুরুর কথা)
(খ) তৃষ্ণায় যাবার সময় ড্রাইভার পথ ভুল করলে সঠিক রাস্তা খোঁজার প্রসঙ্গে লেখকের সরস মন্তব্যঃ ''এই একটা বস্তু, আমরা হারালে খুঁজি । কিন্তু পেলে সাথে করে নিই না । শুধু পথের স্মৃতিটুকুই বয়ে নিয়ে যাই ৷'' (চক্ষে আমার তৃষ্ণা)
(গ) নিজের পেশা নিয়ে অনেকেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেনা, কিন্তু অরিন্দমবাবু এমন নন । তাইতো এক ড্রাইভার বিরক্তির সুরে যখন বলেন - ''জীবনে একশত আটটা পাপ করলে ড্রাইভার হিসেবে মানুষ মর্ত্যে আসে', তখন নিজের পেশায় সন্তুষ্ট অরিন্দমবাবু বলতে পারেন- ''জীবনে একশত আটটা পাপ করলে পুলিশ হিসেবে মানুষ মর্ত্যে আসে'। আর মর্ত্য স্বর্গের চেয়ে সুন্দর । মর্ত্যের সৌন্দর্য স্বর্গের মতো স্থবির নয়।'' (বনবীথি)
এ গ্রন্থে লেখকের জীবনদর্শনও মূর্ত হয়ে উঠেছে । তাইতো আমাদের এই মানবজীবন সম্পর্কেও তিনি করতে পারেন এমনি সরস মন্তব্যঃ
"আমরা একটিই জীবন বাঁচি । যেন একদিবসীয় ক্রিকেট খেলা । ব্যাট করতে গিয়ে ব্যাটে-বলে হলে ভালোলাগে । পরাস্ত হলে বা বল নষ্ট করলে নিজেরই খারাপ লাগে । জীবনটাই এমন।''
পরিশেষে একথা বলতে পারি যে, ঝরঝরে ছাপাই-বাঁধাই ও দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে সুশোভিত অরিন্দমবাবুর 'নাম রেখছি বনলতা' সত্যিই এক চমৎকার রম্যকথা । ত্রিপুরা সম্পর্কে কৌতূহলী গবেষক ও ত্রিপুরা ভ্রমণে ইচ্ছুক পর্যটক, কিংবা সাহিত্যানুরাগী পাঠক- সকলের দ্বারাই যে এ গ্রন্থ বিশেষ ভাবে সমাদৃত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই । তাই এমন একটি গ্রন্থ প্রকাশের জন্যে অজস্র ধন্যবাদ জানাই বুক-ওয়ার্ল্ড-এর কর্ণধার শ্রদ্ধেয়া অঞ্জনা দামকে এবং আন্তরিক অভিনন্দন জানাই গ্রন্থকার অরিন্দম নাথ মহাশয়কে ।
ড. রবীন্দ্র কুমার দত্ত
বাংলা বিভাগ
রামঠাকুর কলেজ
আগরতলা
Subscribe to:
Posts (Atom)