Monday 6 February 2017

পুস্তক পর্যালোচনা 'নাম রেখেছি বনলতা' (২০১৭)- অরিন্দম নাথ

পুস্তক পর্যালোচনা
'নাম রেখেছি বনলতা' (২০১৭)- অরিন্দম নাথ

প্রকাশক-         শ্রীমতী অঞ্জনা দাম, বুক ওয়ার্ল্ড, আগরতলা
প্রচ্ছদ- শ্রী অপরেশ পাল
বিনিময়-         ২৫০ টাকা

                        ত্রিপুরা রাজ্যের আরক্ষা  দপ্তরের  স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ সুপার অরিন্দম নাথ সাহিত্যের ভুবনেও তাঁর অবাধ বিচরণ তাই তাঁকে সব্যসাচী বলেও আখ্যা দেওয়া যায় ২০১৬ পর্যন্ত তাঁর ৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রতিটি গ্রন্থই প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বর্তমান বর্ষে (২০১৭) প্রকাশিত  'নাম রেখেছি বনলতা' তাঁর ৭ম গ্রন্থ সত্যিই, এটি এক অভিনব গ্রন্থ ১৮৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে 'অধরা  মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে', 'মুড়ির টিনের স্মৃতি', ‘মহুরি নদীর  উৎস স্রোতে', 'চক্ষে আমার তৃষ্ণা', 'গান্ধারীর ঐশ্বর্য', এধরনের মোট ৩৯ টি গল্প স্থান পেয়েছে কিন্তু সাহিত্যের রূপ রীতি অনুসারে 'ছোট গল্প' (short story)  বলতে যা বোঝায় এগুলিকে ঠিক তেমনি ছোটগল্প হয়তো  বলা  যাবে না লেখকও  লেখাগুলিকে   কয়েকটি  সফরের বর্ণনা বলে  উল্লেখ করেছেন কিন্তু আমার মনে  হয়, এগুলিকে একথায় রম্য কথা বলে আখ্যা দেওয়া যেতে  পারে কারণ লেখাগুলো পড়তে পড়তে পাঠাকের মনে হয় যে, তাঁদের এক আপনজন যেন শীতের রাতে আগুন পোহাতে পোহাতে তাঁদের সাথে একের পর এক মনোমুগ্ধকর কথা বলে চলেছেন কী নেই এসব কথায় ? সবই  আছে বাস্তব ঘটনা, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, ভূগোল, রূপকথা, উপকথা, পুরাকাহিনি (Myth),  এডভেঞ্চার, গোয়েন্দা রহস্য, দুর্বৃত্ত ধরণ দমন  ইত্যাদির সঙ্গে লেখকের কল্পনার রঙে সম্মিলনে এসব সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠেছে এক অভিনব সাহিত্য
                       

                        লেখকের ছাব্বিশ  বছরের  চাকরির প্রথম দশ বছর কেটেছে সমগ্র ত্রিপুরার গ্রাম-গঞ্জে, পাহাড়-অরণ্যে উগ্রপন্থী দমনে সেই বৈরী দমনে তাঁর তাঁর সহযোগীদের রোমাঞ্চকর, বিপদসংকুল অভিযানের সাফল্য ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বাস্তবের সঙ্গে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে এক অভিনব সাহিত্যের ঝুলি আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছেন পড়তে পড়তে মনে হয়, ত্রিপুরাকে তাঁর মত এত গভীর ভাবে জানেন এমন লোক আর কেউ আছেন কিনা সন্দেহ সমগ্র ত্রিপুরার রাজপথ  থেকে গলি, সমতল থেকে পাহাড়, 'মাকড়সার জালের মত' বন্য পথ-ঘাট, সবই যেন তাঁর হাতের তালু তাই এই গ্রন্থটি পর্যটকদের কাছেও একটি বিশ্বস্ত  ভ্রমণ সঙ্গী বলে বিবেচিত হবে ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানের নামকরণ সম্পর্কিত নানান অজানা কথাও লেখক আমাদের শুনিয়েছেন তাঁর মতে, ককবরকে  জলপ্রপাতকে বলা হয় 'দুঙ্গুর' বাংলা ভাষীদের কল্যাণেই নাকি তা হয়ে গেছে 'ডুম্বুর' তেমনি 'টাকার জলা' নামটিও নাকি এসেছে ককবরক শব্দ 'তখা জলাই' থেকে, বাঙ্গালিদের দ্বারা  রূপান্তরিত হয়ে এমনি ' বিশ্রামগঞ্জ',  'ফুলকুমারী', ছৈলেংটা', 'জামজুড়ি' মত অসংখ্য স্থান নামের ব্যাখ্যাও করেছেন লেখক

                        চোর-ডাকাত, উগ্রপন্থীদের বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের বর্ণনা যেমনি দিয়েছেন, তেমনি তাঁদের পাকড়াও করার কাহিনিও লিপিবদ্ধ করেছেন রয়েছে চাবি কিংবা মাধুরীর মত উপজাতি মেয়েদের সাহায্যে খুনী উগ্রপন্থীদের আটক করার কাহিনিও চাবির সহায়তায় অরিন্দমবাবুরা যেমনি তারই এক আত্ম সমর্পণকারী বৈরী খুনী ভাইটিকে ধরতে পেরেছিলেন, তেমনি মাধুরীর সহায়তায় এক অভিযানে নেমে দুটি উগ্রপন্থীকে সেদিন ধরতে না পারলেও কিন্তু একটি .কে. ৪৭ কে উদ্ধার করতে পেরেছিলেন সেদিন মাধুরী নাকি উগ্রপন্থী দুটিকে  তার টংঘরে কথার জালে দীর্ঘসময়  জড়িয়ে রেখেছিল পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে এমনি নানান রুদ্ধশ্বাস ঘটনার একটি অপরূপ মালা যেন গ্রন্থ  

                        চা পাতার আবিষ্কার কীভাবে হল, পাছড়ার রঙ নক্সা দেখে কীভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপজাতি রমণীদের চেনা যেতে পারে, জোঁকের কামড়ে রক্ত বন্ধে যে শিমূল তূলা অব্যর্থ, কিংবা মাকড়সারা কীভাবে জাল বোনে ইত্যাদি অজস্র তথ্যও পাঠক গ্রন্থ থেকে জানতে পারেন

                        অরিন্দমবাবুর সদা হাস্য মুখের মত তাঁর ভাষাও হাস্যোজ্জল তাইতো তিনি কৌতুকের ভঙ্গিমায় বলতে পারেনঃ

() ''উগ্রবাদীরা পুলিশ আধা-সামরিক বাহিনীর কাছে ঈশ্বরের মতো কারণ ঈশ্বর আমাদেরকে দেখতে পারেন কিন্তু বিপরীতটা সব সময় সত্য নয় ৷৷ (শুরুর কথা)

() তৃষ্ণায় যাবার সময় ড্রাইভার পথ ভুল করলে সঠিক রাস্তা খোঁজার প্রসঙ্গে লেখকের সরস মন্তব্যঃ ''এই একটা বস্তু, আমরা হারালে খুঁজি কিন্তু পেলে সাথে করে নিই না শুধু পথের স্মৃতিটুকুই বয়ে নিয়ে যাই '' (চক্ষে আমার তৃষ্ণা)

() নিজের পেশা নিয়ে অনেকেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেনা, কিন্তু অরিন্দমবাবু এমন নন তাইতো এক ড্রাইভার বিরক্তির সুরে যখন বলেন - ''জীবনে একশত আটটা পাপ করলে ড্রাইভার হিসেবে মানুষ মর্ত্যে আসে', তখন নিজের পেশায় সন্তুষ্ট অরিন্দমবাবু বলতে পারেন- ''জীবনে একশত আটটা পাপ করলে পুলিশ হিসেবে মানুষ মর্ত্যে আসে' আর মর্ত্য স্বর্গের চেয়ে সুন্দর মর্ত্যের সৌন্দর্য স্বর্গের মতো স্থবির নয়'' (বনবীথি)

            গ্রন্থে লেখকের জীবনদর্শনও মূর্ত হয়ে উঠেছে তাইতো আমাদের এই মানবজীবন সম্পর্কেও তিনি করতে পারেন এমনি সরস মন্তব্যঃ

            "আমরা একটিই জীবন বাঁচি যেন একদিবসীয় ক্রিকেট খেলা ব্যাট করতে গিয়ে ব্যাটে-বলে হলে ভালোলাগে পরাস্ত হলে বা বল নষ্ট করলে নিজেরই খারাপ লাগে জীবনটাই এমন''

            পরিশেষে একথা বলতে পারি যে, ঝরঝরে ছাপাই-বাঁধাই দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে সুশোভিত অরিন্দমবাবুর 'নাম রেখছি বনলতা' সত্যিই এক চমৎকার রম্যকথা ত্রিপুরা সম্পর্কে কৌতূহলী গবেষক ত্রিপুরা ভ্রমণে ইচ্ছুক পর্যটক, কিংবা সাহিত্যানুরাগী পাঠক- সকলের দ্বারাই যে গ্রন্থ বিশেষ ভাবে সমাদৃত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই তাই এমন একটি গ্রন্থ প্রকাশের জন্যে অজস্র ধন্যবাদ জানাই বুক-ওয়ার্ল্ড-এর কর্ণধার শ্রদ্ধেয়া অঞ্জনা দামকে এবং আন্তরিক অভিনন্দন জানাই গ্রন্থকার অরিন্দম নাথ মহাশয়কে

. রবীন্দ্র কুমার দত্ত
বাংলা বিভাগ
রামঠাকুর কলেজ
আগরতলা